News Details

পুলিশ সংস্কার প্রস্তাবনা
বাংলাদেশের পুলিশকে ‘জনবান্ধব, জবাবদিহিমূলক, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও আধুনিক, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, নিরপেক্ষ ও আইনের শাসনে অনুগত’বাহিনী হিসাবে গঠনের লক্ষ্যে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) নিন্মোক্ত প্রস্তাব পেশ করছে।
১. পুলিশ বাহিনীকে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত করার জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে। পুলিশকে সত্যিকার অর্থে জনবান্ধব করতে পুলিশ সদস্যের নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি, পদাবনতি (পুরস্কার ও শাস্তি) ইত্যাদি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে বিদ্যমান আইনে পরিবর্তন আনতে হবে এবং এই সকল কর্মযজ্ঞ পুলিশ কমিশন দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। প্রশিক্ষণের আলোকে পুলিশকে পেশাদারিত্বের আওতায় এনে এ কমিশন একজন পুলিশ সদস্যের দায়িত্ব-কর্তব্য ও কর্মপরিধি ঠিক করবে।
২. পুলিশের আইন সংস্কার করতে হবে। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের পরিবর্তে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য একটি যুগোপযোগী পূর্ণাঙ্গ পুলিশ আইন প্রনয়ণ করতে হবে।
৩. পুলিশ বাহিনীর অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের তদন্ত করার জন্য আরেকটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এই সংস্থায় আইন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং কমিউনিটি নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সংস্থাটি নিয়মিতভাবে তদন্ত, ফলাফল এবং নেওয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।
৪. পুলিশকে রাজনীতিকরণ থেকে বিরত রাখতে হবে। নিয়োগ, পদন্নোতি ও বদলির ক্ষেত্রে ব্যক্তির রাজনৈতিক আদর্শ, ধর্মীয় বিশ্বাস, ভাষা, লিঙ্গ, বর্ণ, সম্প্রদায় ইত্যাদি বিবেচনা পরিহার করতে হবে।
৫. আধুনিক পুলিশ গঠনে পুলিশকে মানবিক হিসাবে তৈরি করতে হবে। এ জন্য মানবাধিকার সুরক্ষায় আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার সনদের নির্দেশাবলি যথাযথ অনুসরণ, মানবাধিকার বিষয়ে পুলিশকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের মানবাধিকার বিষয়ে অর্জিত স্কোর ‘পুরস্কার বা তিরস্কারে’অর্ন্তভুক্ত করা। প্রতি বছর পুলিশের প্রত্যেক সদস্যের জন্য মানবাধিকার বিষয়ে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের আয়োজন করতে হবে।
৬. পুলিশকে জনবান্ধব করতে হবে। এ জন্য পুলিশকে জনগণের সঙ্গে মিথস্ত্রিয়া বাড়াতে হবে এবং মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। পুলিশ কর্মকর্তা বা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সব দল, মত, ধর্ম এবং বর্ণনির্বিশেষে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে কমিউনিটি ও বিট পুলিশিংয়ের সেটআপ তৈরি, তাদের অফিস, প্রশিক্ষণ ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
৭. পুলিশ সদস্যরা সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটি পান না। তাঁদের বেশির ভাগ সময় শুক্র-শনিবারসহ অন্য ছুটির দিনগুলোতে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ জন্য পুলিশের সব স্তরের সদস্যের জন্য ‘পুলিশ ভাতা’ চালু করা যেতে পারে। পুলিশ সদস্যরা দিনে আট ঘণ্টার বেশি সময় দায়িত্ব পালন বা কাজ করেন। আট ঘণ্টার বেশি দায়িত্ব পালন করলে তাঁকে ‘ওভার টাইম’ দিতে হবে। সপ্তাহে এক দিন ছুটি দিতেই হবে।
৮. পুলিশকে চায়নিজ রাইফেল বা কোন ধরনের মরনাস্ত্র দেওয়া যাবে না। দাঙ্গা বা বিক্ষোভ দমনে কোন ধরনের মরনাস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। আন্দোলন দমানোর সময় মারনাস্ত্র ব্যবহৃত হলে শাস্তির বিধান রাখতে হবে। যদি কোনো অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনীর মোকাবিলা করতে হয়, সে ক্ষেত্রে সশস্ত্র প্রতিরোধ করতে স্পেশাল আর্মড ফোর্স বা বিশেষ ইউনিট থাকতে পারে।
৯. পুলিশের শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের শক্তি প্রয়োগের নীতিমালা অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে, অর্থাৎ সর্বনিম্ন শক্তি প্রয়োগ, সমানুপাতিক হারে শক্তি প্রয়োগ, যৌক্তিক বা আইনসিদ্ধভাবে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। এই শক্তি প্রয়োগের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
১০. বাংলাদেশ পুলিশের সব সদস্যের একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেগুলোর মধ্যে পুলিশিং কৌশল আধুনিকীকরণ, নতুন প্রযুক্তিতে প্রবর্তন, মানবাধিকার, সন্ত্রাসবাদ, সাইবার অপরাধ, মাদকাসক্তি ও মাদক পাচারের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এর পাশাপাশি ব্যক্তিত্ব ও সম্মান, প্রেরণা ও প্রেষণা, জনগণের মনস্তত্ত্ব, গণজমায়েত ব্যবস্থাপনা, বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান, আবেগগত বা মানসিক বুদ্ধিমত্তা, শৃঙ্খলা, সততা ও সাধুতা, সংহতি, বন্ধন ও ঐক্য, নিজের ইউনিট এবং ডিপার্টমেন্টের প্রতি ভালোবাসা, দেশের মানুষকে ও দেশকে ভালোবাসা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখযোগ্য।
১১. পুলিশ সদস্যদের পদোন্নতি, পদায়ন ও প্রশিক্ষণের একটি নীতিমালা থাকতে হবে। নীতিমালাটি যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। তাহলে পদোন্নতি বা পদায়ন নিয়ে কারও সংক্ষুব্ধ হওয়ার সুযোগ কমে যাবে।
১২. বাংলাদেশের পুলিশের সদস্যদের মানসিক ও আবেগপ্রবণ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার জন্য মানসিক ও আবেগপ্রবণ ইউনিট গঠন করা যেতে পারে। সে জন্য কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল ও বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে এ–জাতীয় ইউনিট গঠন করা যেতে পারে। এ ছাড়া ক্রাইম এনালাইসিস বা অপরাধ বিশ্লেষণ ইউনিট গঠন করা যেতে পারে। ওই ইউনিটের সদস্যরা ডেটা বা তথ্য বিশ্লেষণ করবে এবং তথ্যকে ইন্টেলিজেন্সে পরিণত করবে ও ইন্টেলিজেন্সকে এভিডেন্সে পরিণত করবে। তা ছাড়া পুরো দেশের অপরাধীদের তথ্য নিয়ে একটা ‘ডেটাবেজ’ তৈরি করবে, যেখান থেকে অন্য সব ইউনিট সাপোর্ট বা সহযোগিতা পাবে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক বড় বড় ইউনিট, যেমন মেট্রোপলিটন পুলিশ, রেঞ্জ, জেলা, পিবিআই ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের জন্য নিজ নিজ সাব-ইউনিট বা শাখা চালু করা যেতে পারে।
১৩. ইন্টেলিজেন্সভিত্তিক পুলিশিংয়ের মাধ্যমে তথ্য যাচাই-বাছাই করা, অভিযান ও কাজের ক্ষেত্রে ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে বিবেচনায় এনে যাচাই-বাছাই করে পুলিশের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা দরকার।
১৪. পুলিশের আবাসন সমস্যা বিশেষ করে থানা ও পুলিশ লাইনসের আবাসন সমস্যার সমাধান করতে হবে। সব ফোর্স ও অফিসারের মধ্যে ঐক্য আনতে হবে। পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে জেলা পর্যায়ে কার্যকর একটি আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পুলিশের একটা অংশকে তাদের পছন্দ বা ব্যাকগ্রাউন্ড অনুসারে অপারেশন, প্রশিক্ষণ, তদন্ত, গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড, জনতা ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী করে তুলতে হবে এবং তাদের সংশ্লিষ্ট বিশেষায়িত ইউনিটেই পদায়ন করতে হবে।
১৫. পুলিশ কর্তৃক সংঘটিত যেকোনো অপরাধ সঠিক ও সুচারু তদন্ত করতে হবে। বাংলাদেশ পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ক্ষমতায়ন ও সেই সঙ্গে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
১৬. আইনের অপব্যবহার রোধে মামলা রুজুর ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর সংশ্লিষ্ট ধারাটির সংস্কার করতে হবে। পুলিশ হেফাজতে বা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ১৬৭ ধারার সংস্কার করতে হবে। কাউকে সন্দেহ হলে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। এতে অনেকে হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই ধারাটি বাতিল করতে হবে।
১৭. পুলিশের দ্বারা গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনকে দ্রুত জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কাজকর্মের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সবার জন্য উন্মুক্ত, স্থায়ী ‘অভিযোগ কমিশন’স্থাপন করতে হবে।
১৮. সাদা পোশাকের অভিযান ও গ্রেফতার বন্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্রেফতার এর ক্ষেত্রে নির্ধারিত পোষাকে ও আইডি দৃশ্যমান রাখার বিধান নিশ্চিত করতে হবে। অণ্যথা হলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করতে হবে।
১৯. অন্য এলাকায় অপারেশন চালনা প্রাক্কালে লোকাল পুলিশকে অবহিতকরণ এবং উপস্তিতি নিশ্চিত এর বিধান বাস্তবায়ন করতে হবে।
২০. সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় একটি স্বাধীন ‘পুলিশ ন্যায়পাল’ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী সংস্কারের জন্য কঠোর কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা অপরিহার্য। একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা, প্রশিক্ষণ ও পেশাদার উন্নয়নে বিনিয়োগ, নিয়োগ পদ্ধতি সংস্কার, কমিউনিটি পুলিশিং এবং জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আধুনিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে পারে। এই সংস্কারগুলি দেশের সুরক্ষা ও সুবিচারের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।